এমসি কলেজের ভেতরের গল্প

প্রকাশিত: ৬ অক্টোবর ২০২০, ৪:২১ অপরাহ্ণ

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ( এমসি) কলেজ। তৎকালীন আসাম প্রদেশের  এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভিতর ঘটতো অমানবিক কিছু কাজ।  রাজনৈতিক  বিভিন্ন  বিষয়ের কারণে যেগুলো বরাবরই চাপা পড়ে থাকতো। গত কয়দিন আগে কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা এক গৃহবধূকে ছাত্রাবাসে নিয়ে গণধর্ষণ করে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী। বিষয়টি প্রচার হলে এমসি কলেজসহ সারা দেশ এর বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। বেড়িয়ে আসতে শুরু করে এমসি কলেজের ভেতরে চলা অমানবিক কাজগুলোর কথা।  তারই কিছু বর্ণনা তুলে ধরেছেন এই কলেজেরই এক সাংবাদিক।সকলের বুঝার স্বার্থে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আপলোড করা  তার এই পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হল

”জানেন কি এমসি কলেজের ভেতরে কি হয়? প্রশাসনই বা কেন নিরব থাকে? হুম.. চলুন কিছুটা ধারণা দেওয়া যাক।

গতকাল রাত থেকে শুরু হয়েছিল। কলেজের কীটদের অতীত আর বর্তমানের আমলনামা টাইপিং করতে করতে হাতে ব্যাথা করছে আমার। সবে সকাল হয়েছে, রাজশাহী থেকে এক সহকর্মী ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কলেজের আপডেট কি ভাই? একটু পরেই সিলেটের আরেক সাংবাদিকদের ফোন, নতুন কিছু পেলে একটু জানিও আশরাফ। খাবার খেতে বসেছি ডিজিএফআইয়ের এক এস আই ফোন দিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করেন। টাইপের সাথে সাথে এখন অবধি ৬৯টার মতো কল রিসিভ করতে হয়েছে আমাকে। মাথা কাজ করছে না আমার।

এমসি কলেজ। যেটাকে বরাবরই বলি, আমার ক্যাম্পাস। হুম আমার ক্যাম্পাস। কারণ ২০১৬ থেকে ২০। চার বছর ধরে এই কলেজে সাংবাদিকতা করে আসছি আমি। যেকারণে এখানটার অন্য ৮-১০টা শিক্ষার্থী থেকে একটু বেশিই আবেগ কাজ করে। এর ১৪৪ একরের অধিকাংশ সম্পর্কেই অবগত আমি।একেবারে অধ্যক্ষের রুম থেকে শুরু করে বালুচরের শেষ সীমানা পর্যন্ত। কে কোথায় কি করছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে এর অধিকাংশই জানতে পারি আমি। আমাদের চোখের সামনেই এই কলেজ জাহেলি যুগের অনেক দৃশ্য ঘটে। এমনিতে তো কতোই না ভাল এমসি কলেজ! হুম সবাই এটাই বলে। দুর থেকে মানুষ যা দেখে তাই তো বলবে, তাইনা? আজ সত্যির কিছুটা উল্লেখ করছি। এখানকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাক স্বাধীনতা নেই। নেই অভিযোগ দেওয়ার জায়গাও। চলুন ব্যাখ্যা করে বুঝাই।

এখানকার শিক্ষার্থীরা সত্যিই অসহায়। নিউজে বাস্তবটা তুলে ধরতে চাইলে, আমাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছু লিখতে গেলেই মানুষ গড়ার কারিগরদের কাছ থেকেই বিভিন্নভাবে ছাত্রত্ব বাতিল করে দেওয়ার হুমকি পাই,( যে গল্পগুলো আমরাই জানি কেবল)। তারপরও মাঝে মধ্যেই আমরা নিউজ করি। ক্যাম্পাসের অবস্থা তুলে ধরার অপরাধে আমাদের উপর হামলা হয়। আমরা আক্রন্ত হই। নিরব থাকে এমসি প্রশাসন।

২০১৬ সালের ঘটনা।গায়ে টাচ লাগার কারণে আমার এক বন্ধুকে বেদরুক মার শুরু করে আজকের অভিযুক্ত শাহ রনি নামের অপরাধীটা। আজকে যারা রনির বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই ঐদিন কিছু না শুনে রনির হয়ে আমার বন্ধুটার উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল!!

২০১৮ সালের ঘটনা। মোহনার বসন্ত বরণ উৎসবে হামলা করে সরকারি ও এমসি ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। তার ছবি তুলতে গেলে আমাদের ক্যামেরাম্যান কে প্রচন্ড ভাবে আঘাত করে। ক্যামেরা ভাংচুর করে। বাদ যায়নি সাংবাদিকরাও। পরে তাদের গডফাদাররা অফিসে গিয়ে বিষয়টি শেষ করে। আমাদের নেতাদের পায়ে ধরে, হুম পায়ে ধরে ভবিষ্যতে এরকম কাজ না করার মুসলেকা দিয়ে আসে। তখনও নিরব ছিল এমসি প্রশাসন।

২০১৯ সালের ঘটনা। ক্যাম্পাসে অবৈধভাবে থাকা বহিরাগতদের নিয়ে নিউজ করি। আমার উপর ক্ষেপে যায় ছাত্রলীগ নামধারী কিছু জারজ সন্তান। আজকের ঘটনার মূল হোতা সাইফুর আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।ঐদিন হুমকি না দিলেও তার সাথে ছিল শিহাবসহ ছাত্রলীগের আরেক নেতা। হুমকির কথা শুনে নিরব থাকি আমি। বিষয়টা তখন সিলেটের অনেক সাংবাদিকদের কানে পৌঁছে গেছে। পরে তাদের গডফাদারের হুংকারে এইদিন বিকেলেই ছাত্রলীগ নেতা হুসাইন আহমেদ সহ সাইফুর এসে ঐ ঘটনার জন্য আমার কাছে মাফ চায়। মানবিক কারণে বিষয়টা বড় করিনি আমি।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ঘটনা। আজকের ঘটনায় অভিযুক্ত এক পশু আমার এক সহপাঠীকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। সে রাজী না হওয়ার রাস্তাঘাটে তাকে বিরক্ত করতে থাকে। এর কদিন পরেই হুমকি দেয় প্রেমে রাজী না হলে কলেজ আসতে পারবি না বলে। তার এক ছোট ভাইকেও দেখে নেওয়ার হুংকার দেয়। সহপাঠী বিষয়টা আমার সাথে শেয়ার। পরে ছাত্রলীগের ঐ গডফাদারের সাথে সরাসরি বিষয়টা নিয়ে আলাপ করলে আমার ঐ সহপাঠীর কাছে মাফ চায় এমসি ছাত্রলীগের পশুটা।

২০১৭ সালের ঘটনা। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন এমসি কলেজে আসবেন। কলেজ ছাত্রলীগ তাকে নিয়ে মিছিল করবে। এরজন্য ছাত্রদের কে ক্লাস থেকে ঢেকে ঢেকে নিয়ে আসা হচ্ছে। নিউজ সংগ্রহের জন্য ক্যাম্পাসের গেইটেই আমরা অবস্থান করছি। আজকের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগের মাহফুজ নামের অপরাধীটা হঠাৎই দেখলাম একটা ছাত্রকে চড়থাপ্পড় মেরে মেরে প্রশাসনিক ভবনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর পাশে থাকা ৪-৫ জন সেটা দেখেছে আর হাসছে। দৌড়ে গিয়ে ঘটনা কি জানতে চাইলে, ঐ শিক্ষার্থী বলে” ভাই আমার খালা রাকিব আলি মেডিকেলে ভর্তি এখনই যাওয়ার জন্য কল দিছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের ঐ ভাই ইটা বিশ্বাস কররা না, মিছিলে এখন যাইতাম পারতাম না কইছি দেখি আমারে মাররা। ”

ছাত্রলীগ করে বলে নিজ ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের সাথে প্রভাব খাটায়। শিক্ষকদের সাথে অসদাচরণ করে। ২০১৯ সালের নভেম্বরের ঘটনা। মতের বিরুদ্ধে গেলে আমরা এক বন্ধুকে এক সহপাঠী কলারে ঝাপটে ধরে।বড়ভাইদের নিয়ে মারতে আসে। পরে বিষয়টা শেষ করি।আমার মনে হয় এমসি কলেজের প্রতিটা ডিপার্টমেন্টই এমন ভাবে আক্রান্ত হয়। তারপরও কেউ মুখ খুলে না। মেরে ফেলার ভয়। আক্রান্ত হবার ডরে।

বাংলাদেশের ইতিহাস ঘেঁটে ছাত্রলীগের প্রতি অন্যরকম একটা ভালবাসা ভাললাগা কাজ করতো আমার। বাট দু’চারজন ছাড়া এখানকার বা এমন ছাত্রলীগ কে আমি ঘৃণা করি। থুথু দেই।

একরকম শতক ঘটনা আমার সামনেই ঘটেছে। যার কোন ইয়ত্তা নেই। হয়নি কোন স্থায়ী সমাধানও।

খুব কাছ থেকেই থেকেই দেখছি কলেজের কোন কাজে সাধারণ একটা শিক্ষার্থী গেলে কেমন আচরণ করা হয়। অথচ কত নরম সুরেই না কথা বলে ওরা। তারপরও অধ্যক্ষের অফিস থেকে শুরু করে কোথাও কাঙ্খিত গুরুত্ব পায় না এমসিয়ানরা ।

ওপর দিকে টেবিলে তাবড়িয়ে কথা বলা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের জামাই আদর করা হয়। কেন করা হয় জানি না । আচ্ছা আওয়ামীলীগের হাই কমান্ড কি কখনো বলে যে ছাত্রলীগকে খুশি করেই সবাইকে চলতে হবে??? স্বাধীনতার পক্ষের দলটি কাছ থেকে এমন আচরণ কোনদিনই আসবে না। এটা আমার বিশ্বাস।
তাইলে কেন ছাত্রলীগের কাছে এতো হেট হয়ে চলতে হয় আপনাদের??
আপনাদের নতজানু নীতির কারণেই সাধারণ শিক্ষার্থী তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আক্রান্ত হয় আমার ক্যাম্পাস।

আমার ক্যাম্পাসের বেড়াতে এসে মায়ের জাতের প্রতিনিধিটা আজ ধর্ষণের স্বীকার হয়! আমার ক্যাম্পাসের ১২৮ বছরের ঐতিহ্য আর সুন্দর্য আজ কেন কার জন্য, কাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে কলঙ্কিত হল???আজকের এই ঘটনাটি একপক্ষীকভাবে দেখলে চলবে না। এটা একদিনে হয় নি। একদিনেই এমন পরিবেশ তৈরি হয়নি মুরারিচাঁদে।

” ছাত্রলীগের কমিটি চাই”দিতে হবে দিতে হবে “হুম আপনারা যারা কমিটির জন্য দু’দিন পর পরই চিল্লাচিল্লি করেন।ফেসবুক ওয়াল ফাটিয়ে দেন। একবারও কি ভাবেন না,যে কেন বিগত ১৪ বছর থেকে এই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ তাদের ইউনিট দিচ্ছে না। গোলাম রব্বানীর বক্তব্য আমি নিজেও এনেছি। আপনাদের প্রতি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কোন আস্থা – ভরসা নেই। ” বছরে একটা ১ টা মার্ডার করবেন, ছাত্রাবাস ভাংচুর করবেন, গরীর ছাত্র ছাত্রীদের হোস্টেল থেকে বের হতে বাধ্য করবেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে অসদাচণ করবেন, মতের মিল না হলেই মারধর শুরু করবেন, শিক্ষকদের সাথে অসদাচরণ করবেন, সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে হামলা করবেন, দু’দিন পর পরই নিজেদের মধ্যে কিলাকিলি করবেন “এসবের পরেই আবার বৈধতা জন্য চিল্লাচিল্লি করেন। অবৈধভাবেই ক্যাম্পাসে যে ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি করে চলেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ যদি আপনাদের বৈধতা দেয় অবস্থা কি হতে পারে নিজেরাই অনুধাবন করুন।

আজকে ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মী নীতিকথা শুনাচ্ছেন।মিডিয়ার সামনে তাদের শাস্তি দাবি করছেন।বিভিন্ন সময় আপনারাই এসব কীটদের অন্যায় কাজে সমর্থন দিয়ে গেছেন। কখনো বা সহযোগিতাও করেছেন। ক্যাম্পাসে নিজেদের ক্রাসের রাজত্ব তৈরি করে রেখেছেন। আপনাদের মতের বাইরে গেলে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এর নাম কি ছাত্রলীগ? এটা সন্ত্রাসলীগ, ছাত্রলীগ না।

আর প্রশাসন আপনারা বরাবরই নিরব কেন? এর পেছনের রহস্যটা কি? আজকের ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না আপনারাও। এই পরিবেশ একদিনে হয়নি, ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্রদল ক্ষমতায় যেই থাকুক, আপনাদের নতজানু নীতির কারণেই ওরা এতোটা ভয়ংকর হয়ে ওটে। নির্যাতিত হয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা,আক্রান্ত হয় আমার ক্যাম্পাস।

 

 

লেখক::আশরাফ আহমেদ
যুগ্ম- সাধারণ সম্পাদক এমসি কলেজ সাংবাদিক সমিতি।