এবারের পূজোতে যত বাধাঁ- থাকছে না বিনোদনও !

প্রকাশিত: ১৬ অক্টোবর ২০২০, ৩:০০ অপরাহ্ণ


জাগোভাটি ডেস্ক:: নতুন সব নিয়ম আর বিভিন্ন বাধাঁ বিপত্তির কারনে এবারের পূজাতে কমে যাবে আমেজের মাত্রাও।   করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ভাটা পড়তে যাচ্ছে দুর্গাপূজার উৎসবে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব এবার ধর্মীয় রীতি পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। থাকবে না উৎসবের আমেজ এবং আয়োজন। স্বাস্থ্যবিধি পালন এবং করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হবে দুর্গাপূজা। পূজা উদযাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
হিন্দু পুরাণ মতে, দুর্গাপূজার সঠিক সময় বসন্তকাল; কিন্তু বিপাকে পড়ে রামচন্দ্র, রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি সে পর্যন্ত অপেক্ষা না করে শরতেই দেবীকে অসময়ে জাগিয়ে পূজা করেন। সেই থেকে অকালবোধন হওয়া সত্ত্বেও শরৎকালেই দুর্গাপূজা প্রচলন হয়ে যায়। সনাতন ধর্ম মতে, যা কিছু দুঃখ-কষ্টের বিষয়, যেমন বাধাবিঘ্ন, ভয়, দুঃখ-শোক, জ্বালা-যন্ত্রণা এসব থেকে ভক্তকে রক্ষা করেন দেবী দুর্গা। শাস্ত্রকাররা দুর্গা নামের অর্থ করেছেন ‘খের দ্বারা যাকে লাভ করা যায় তিনিই দুর্গা’। দেবী দুঃখ দিয়ে মানুষের সহ্যক্ষমতা পরীক্ষা করেন। তখন মানুষ অস্থির না হয়ে তাকে ডাকলেই তিনি তার কষ্ট দূর করেন। এ বছর ভক্তদের কষ্ট দূর করতে দেবী দুর্গা আসবেন দোলায় এবং বিদায়ও নেবেন গজে চড়ে। বিজয়া দশমী দেবী দুর্গাকে বিদায় জানানোর দিন। এই দিনটি শেষ হয় মহা-আরতির মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার সব কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।

এবার মণ্ডপের সংখ্যা কমছে

সারাদেশে এবার ৩০ হাজারের কাছাকাছি সংখ্যক মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। পূজার জন্য রাজধানীতে প্রস্তুত হবে ২২৮টি মণ্ডপ। তবে এই সংখ্যা কিছুটা বাড়তে পারে। বিগত বছর সারাদেশে মণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৩৯৮টি, যা তার আগের বছরের চাইতে ৪৮৩টি বেশি। আর রাজধানীতে পূজা মণ্ডপ ছিল ২৩২ টি।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ জানিয়েছে, ২০১৮ সালে ৩১ হাজার ২৭২টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার মধ্যে রাজধানীতে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৩৪টি মণ্ডপে। ২০১৭ সালে সারাদেশে ২৯ হাজার ৭৪টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং রাজধানী ঢাকায় মণ্ডপের সংখ্যা ছিল ২২৫টি।

পূজা উদযাপনে স্বাস্থ্যবিধি

এবার দুর্গাপূজায় শোভাযাত্রা ও প্রসাদ বিতরণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। করোনার কারণে দুর্গাপূজায় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে সম্প্রতি ১১টি নির্দেশনা দিয়ে গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে। গত ১২ অক্টোবর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জনস্বাস্থ্য-১ অধিশাখার উপসচিব ডা. মো. শিব্বির আহমদ ওসমানী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে গাইডলাইন মেনে চলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

গাইডলাইনে বলা হয়েছে, মন্দির প্রাঙ্গণে নারী-পুরুষের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ পৃথক ও নির্দিষ্ট থাকতে হবে। পূজামণ্ডপে আগত ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট দূরত্ব (কমপক্ষে দুই হাত) বজায় রেখে লাইন করে সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করবেন এবং প্রণাম শেষে বের হয়ে যাবেন। সম্ভব হলে পুরো পথ পরিক্রমা গোল চিহ্ন দিয়ে নির্দিষ্ট করতে হবে। পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। ভক্তের সংখ্যা অধিক হলে একাধিকবার পুষ্পাঞ্জলির ব্যবস্থা করতে হবে। পূজামণ্ডপে আগত সবার মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক। মাস্ক পরিধান ছাড়া কাউকে পূজামণ্ডপে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। মন্দিরের প্রবেশপথে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য থার্মাল স্ক্যানারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সর্দি, জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট নিয়ে কেউ পূজামণ্ডপে প্রবেশ করবেন না। হাঁচি ও কাশির সময় টিস্যু রুমাল বা কনুই দিয়ে নাক ও মুখ ঢাকতে হবে। ব্যবহৃত টিস্যু বর্জ্য ফেলার জন্য পর্যাপ্ত ঢাকনাযুক্ত বিনের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং জরুরিভাবে তা অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রসাদ বিতরণ, আরতি প্রতিযোগিতা/ধুনচি নাচ এবং শোভাযাত্রা থেকে বিরত থাকতে হবে। ধর্মীয় উপাচার ছাড়া অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং আলোকসজ্জা বর্জন করতে হবে। পূজামণ্ডপে একজন থেকে আরেকজনের নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে বসার স্থানটি নির্দিষ্ট করে দিতে হবে যাতে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিফলিত হয়।

মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মহামারির কারণে আমাদের এবার অনেক কিছু মেনে চলতে হবে। সব ধর্মের মানুষেরই কিন্তু করোনার কারণে এমনটা করতে হয়েছে। আমরা রথযাত্রা করিনি, জন্মাষ্টমী খুব নিয়ন্ত্রিত উপায়ে আমরা পালন করেছি। মহালয়াতেও আমরা কাউকে নিমন্ত্রণ করিনি। টিভিতে দেখানো হয়েছে , অনেকেই ঘরে বসে দেখেছে। এবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের পূজা করতে হবে। ভক্তরা যারা আসবে তাদের প্রত্যেকেরই মাস্ক পড়তে হবে বাধ্যতামূলকভাবে এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে কিন্তু প্রবেশ করতে হবে। এরকম অনেক নির্দেশনা আছে। আমাদের দুর্গোৎসবে সব ধর্মের মানুষ আসে। এবার আমরা দুর্গোৎসব বলছি না, আমরা দুর্গাপূজা বলছি। কোনও প্রকারের উৎসব হবে না।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা

আসন্ন দুর্গা পূজার সার্বিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভার্চুয়াল সভায় সিদ্ধান্তের পর সংশ্লিষ্টদের কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনায় বলা হয়, পূজামণ্ডপে প্রবেশের সময় করোনার প্রেক্ষাপটে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। হাত ধোয়া ও স্যানিটাইজার, মাস্ক বাধ্যতামূলক করতে হবে। পূজামণ্ডপের সংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে সীমিত রাখার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। দেশব্যাপী সর্বজনীন পূজা কমিটির নেতাদের এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা মোকাবিলায় মোবাইল ডিউটিতে থাকবে। প্রতিমা বিসর্জনের সময় কোনও শোভাযাত্রা করা যাবে না।

এতে আরও বলা হয়, ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতে হবে। জনসমাগম সীমিতকরণসহ অন্যান্য নির্দেশনাবলি মিডিয়ায় প্রচারের ক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করবে। করোনার সেকেন্ড ওয়েভ সম্পর্কে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। পূজামণ্ডপ ব্যবস্থাপনায় পূজা উদযাপন কমিটি স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করবেন। জরুরি প্রয়োজনে ৯৯৯-এর সেবা নিতে পারবেন পূজা উদযাপন কমিটি।

এবার পূজার অনুষ্ঠানমালা শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে মন্দির প্রাঙ্গণেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পাঠানো নির্দেশনার মধ্যে এটি অন্যতম। অন্যান্যবার পূজার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকলেও এবার তা হচ্ছে না। তাছাড়া আরতি প্রতিযোগিতা, মেলা সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে। গত ১১ অগাস্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম উৎসব জন্মাষ্টমীও হয়েছে সীমিত পরিসরে, কোনও ধরনের শোভাযাত্রা ছাড়াই। এবার দুর্গা পূজাতেও শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিমা বিসর্জন হবে না। বিসর্জনের জন্য একটি ট্রাকে একসঙ্গে অনেক মানুষ গেলেও এবার একটি ট্রাকে প্রতিমা বিসর্জনের জন্য শুধুমাত্র ১০ জন যেতে পারবে। এর বাইরে অতিরিক্ত কেউ প্রতিমা বিসর্জনের জন্য যাবে না।

প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ আলাদা

করোনা পরিস্থিতিতে মণ্ডপে প্রবেশের এবং বের হওয়ার জন্য আলাদা গেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব গেটে হাত ধোঁয়ার ব্যবস্থা থাকবে এবং স্বেচ্ছাসেবকরা মাস্ক চেক করার জন্য দায়িত্ব পালন করবেন গেটে ও ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপবেন।

টিভিতে ও সামাজিক মাধ্যমে সরাসরি অঞ্জলি দেখার ব্যবস্থা

করোনা মহামারির কারণে অধিক সংখ্যক ভক্তের আগমন এবং শিশু ও বয়স্কদের আগমন নিরুৎসাহিত করতে টেলিভিশনে ও ফেসবুকে সরাসরি অঞ্জলি দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবার। এই প্রসঙ্গে শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, বয়স্ক এবং ছোট শিশুদের জন্য আমরা টেলিভিশনে এবং ফেসবুকে ঘরে বসে অঞ্জলি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখছি। এই জন্য সুনির্দিষ্ট টাইম আমরা টিভির স্ক্রলে দিয়ে দিবো। ঘরে বসে টেলিভিশনের সামনে তারা অঞ্জলি দিতে পারবে।

এবার প্রসাদে খিচুড়ি থাকছে না

সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীতে প্রতিবার প্রায় ভক্তদের জন্য খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকলেও এবার তা থাকছে না। এমনকি প্রতিবার ২৫ হাজার ভক্তদের জন্য রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে প্রসাদে খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকলেও এবার তা থাকছে না। প্রসাদ বিতরণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা থাকায় এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে এই মন্দিরের দায়িত্বে থাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি। এবার শুধু ফলমূলের ব্যবস্থাই করা হবে বলে জানিয়েছেন কমিটির সভাপতি। তিনি বলেন, আমরা এবার ফল প্রসাদে জোর দিচ্ছি। এবার কোন মন্দিরে খিচুড়ি দেওয়া হবে না। এটা একেবারেই বাদ।তবে হাতে একটা ফল দেওয়া যেতে পারে।

জাগোভাটি /আআ/১৬-১০-২০/