করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসলে কি করবেন

প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২০, ২:৩৮ অপরাহ্ণ

জাগোভাটি ডেস্ক:;বলা হচ্ছে করোনার ২য় ঢেউ শীগ্রীই আসছে । একারণে মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যেই আতঙ্ক দেখা দিয়েছে । ২য় ঢেউ আসলে কি করা দরকার সেই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ । করোনাভাইরাস নিয়ে উৎকণ্ঠা, ভয় শেষ না হতেই সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা উঠছে। কেবল পশ্চিমা দেশেই নয়, বাংলাদেশেও দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান এসেছে সরকারের পক্ষ থেকেও। আসলেই কি দ্বিতীয় একটা ঢেউ সামনে অপেক্ষা করে আছে? দ্বিতীয় ঢেউ আসলে কী? তার প্রস্তুতিই–বা কেমন হওয়া উচিত?

কোভিড-১৯ সম্পর্কে এখনো বিজ্ঞানীরা সব জানেন না। সময়ের সঙ্গে এটি দুর্বল হয়ে পড়বে নাকি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে, টিকা আদৌ আসবে কি না বা কবে নাগাদ আসবে, হার্ড ইমিউনিটি আসলেই সম্ভব কি না ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর এখনো ধোঁয়াশায়।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে স্প্যানিশ ফ্লুর মোট তিনটি ঢেউ বা ওয়েভ দেখা গিয়েছিল। এর মধ্যে দ্বিতীয় ঢেউটা ছিল প্রথমটির তুলনায় মারাত্মক। তাই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত বসে থাকার কোনো উপায় নেই। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন করে সংক্রমণের হার বাড়ছে। ইউরোপ আবার কঠোর লকডাউনের কথা ভাবছে। সংক্রমণ আকস্মিক হারে বাড়তে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঙ্গরাজ্যে আর ভারতেও। কিন্তু একে দ্বিতীয় ঢেউ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা দ্বিধায় আছেন। অনেকেই মনে করছেন, প্রথম ঢেউই এখনো শেষ হয়নি। যেহেতু মানুষের বাইরে যাওয়া বেড়েছে, বাড়ছে জনসমাগম, খুলে দেওয়া হয়েছে অনেক কিছু, সে কারণে সংক্রমণের হার বাড়তেই পারে। যাঁরা আগে বের হননি, তাঁরাও এখন বের হচ্ছেন। শিশু-কিশোরেরাও বের হচ্ছে, অনেক দেশে তো স্কুল-কলেজও খুলে গেছে। ফলে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত তরুণ জনগোষ্ঠী, শিশু-কিশোরেরা উপসর্গহীন বাহকে (ক্যারিয়ার) পরিণত হচ্ছে, তারা আবার অন্যদের মধ্যে নিজের অজান্তেই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।

শীতে আমাদের ঘোরাঘুরি, উৎসব, অনুষ্ঠান বেড়ে যায়। কিন্তু এবার শীতে যেকোনো রকম জনসমাগম, উৎসব, অনুষ্ঠান, ভিড় এড়িয়ে চলুন। উৎসব অনুষ্ঠান করতেই হলে সীমিত পরিসরে অল্পসংখ্যক মানুষ নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে করুন।

আমাদের দেশও একই অবস্থা। শহর ও গ্রামে মানুষ নির্ভয়ে চলাফেরা করছে, অনেকেই অপ্রয়োজনে এবং স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্কুল না খুললেও শিশুদের নিয়ে বাবা–মায়েরা বাইরে যাচ্ছেন। শিশুরা সতর্ক থাকতে পারে না বলে বাহকে পরিণত হয়। নিজেদের উপসর্গ না হলেও পরিবারে বয়স্কদের সংক্রমিত করছে তারা।

জনসমাগম বাড়ছে। ফলে সংক্রমণ সামনে বাড়বে। এটি দ্বিতীয় ঢেউ বা প্রথম ঢেউয়ের চলমান অবস্থা। সংক্রমণের হার কমে গিয়ে বা স্তিমিত হয়ে পুনরায় ঊর্ধ্বমুখী হলে তাকে দ্বিতীয় ঢেউ বলা হয়। আমাদের সংক্রমণের হার কি আদৌ কমেছে? আরেকটি প্রশ্ন হলো, যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন বা যাঁদের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, তাঁরা সবাই কি নমুনা পরীক্ষার আওতায় আসছেন? তাই আমাদের এখানে বলা মুশকিল যে এটা দ্বিতীয় ঢেউ না প্রথম ঢেউ?

আসছে শীতে সংক্রমণ বাড়বে?
এমনিতেই শীতকালে মানুষের নানা ধরনের ফ্লু, নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বাড়ে। বাড়ে হাঁপানি বা ব্রংকাইটিস রোগীদের সমস্যা। প্রতিবছর ফুসফুসের নানা রোগ, সংক্রমণ, জ্বর, কাশির রোগীতে শীতকালে আমাদের হাসপাতাল পূর্ণ হয়ে যায়। তাই শীতে কোভিডসহ অন্যান্য ফুসফুসের সংক্রমণ বাড়বে, তা ধারণা করাই যায়।

কোভিড-১৯ কিন্তু শুরু হয়েছিল গত শীতেই, চীনে শীতকালটা তাণ্ডব চালিয়েছিল এই ভাইরাস। তারপর এ বছরের শুরু দিকে ইউরোপ ও আমেরিকাও এর জটিল রূপ দেখেছে। এ ছাড়া গবেষকেরা বলেন, যেকোনো ভাইরাস শীতল ও শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে। শীতে মানুষের বদ্ধ ঘরে থাকার প্রবণতা বাড়ে, ফলে অ্যারোসল ছড়ায় বেশি। শীতে দুনিয়াজুড়ে বয়স্ক ও শিশুদের ফুসফুস সংক্রমণজনিত মৃত্যুহারও সবচেয়ে বেশি থাকে। এ বছর বড়সংখ্যক নবজাতক শিশু লকডাউন ও অতিমারির কারণে যথাসময়ে সব টিকা শেষ করতে পারেনি। সারা পৃথিবীতেই এ অবস্থা। তাই এবার শীতে অনেক বেশিসংখ্যক শিশু নিউমোনিয়া, হুপিং কফ, হাম, মাম্পস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হবে বলে এখনই ধারণা করা হচ্ছে। তাই সামনের শীত নিয়ে কিছুটা আশঙ্কা আছে বৈকি। কারণ এখনো করোনা সংক্রমণ না নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, না এর টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে।

কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
সময়ের সঙ্গে ভাইরাসের মিউটেশন (পরিবর্তন) ঘটে। স্প্যানিশ ফ্লুর বেলায় দ্বিতীয় সংক্রমণ ঢেউয়ে মিউটেটেড বা পরিবর্তিত ভাইরাসের শক্তি ছিল বেশি। আবার কোনো কোনো সময় ভাইরাস পরিবর্তন হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। করোনার ক্ষেত্রে কী হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। যেহেতু টিকা এখনো আসেনি, তাই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো প্রস্তুতি। আসন্ন তথাকথিত সংক্রমণ ঢেউ মোকাবিলা করতে কিছু বিষয় এখনই পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেগুলো হলো—

সবকিছু স্বাভাবিকভাবে আগের মতো চলছে, তার মানে এই নয় যে করোনা সংক্রমণ শেষ হয়ে গেছে। সামাজিক–অর্থনৈতিক কারণে, জীবন–জীবিকার কারণে সব খুলে দেওয়া হয়েছে, মহামারি শেষ হয়ে গেছে বলে নয়। এই কথা মনে রাখা দরকার।

এই স্বাভাবিক মানেও কিন্তু স্বাভাবিক নয়। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বের হতে হচ্ছে বৈকি, তাই বলে সব আগের মতো স্বাভাবিক হয়নি। এখনো বেড়ানো, উৎসব, সামাজিকতা, জনসমাগম করার মতো স্বাভাবিকতা আসেনি।

অনেকেই বলবেন, মৃত্যুহার তো কমে গেছে। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের ঝুঁকি কমেনি মোটেও। পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিটি বা এমন কেউ যাঁর ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, কিডনি রোগ বা জটিল সমস্যা আছে তাঁদের হেলাফেলা করবেন না।

যা মানতে হবে

অপ্রয়োজনে বাইরে যাবেন না। কাজ শেষে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসুন। আপনার পরিবারের কাছে আপনি সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তি। তাই অকারণে ঝুঁকি নেবেন না।

বাইরে গেলে সর্বোচ্চ সতর্কতা মেনে চলুন। যথাসম্ভব দূরত্ব মেনে চলুন। ঘরের বাইরে অবশ্যই মুখে মাস্ক পরবেন। মাস্ক খুলবেন না।

বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস অব্যাহত রাখুন। হাঁচি–কাশির আদবকেতা মেনে চলুন।

অসুস্থবোধ করলে, জ্বর, কাশি বা গলাব্যথা, স্বাদহীনতা দেখা দিলে উপসর্গ যত মৃদুই হোক, নিজেকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলুন। পরীক্ষা না করা বা চিকিৎসকের পরামর্শ না নেওয়া পর্যন্ত বের হবেন না।

বাড়ির সবার কাছ থেকেও দূরে থাকুন। এখন অনেকেরই মৃদু উপসর্গ হচ্ছে, আর তা নিয়েই সবাই বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটা অন্যায়।

শীতে আমাদের ঘোরাঘুরি, উৎসব, অনুষ্ঠান বেড়ে যায়। কিন্তু এবার শীতে যেকোনো রকম জনসমাগম, উৎসব, অনুষ্ঠান, ভিড় এড়িয়ে চলুন। উৎসব অনুষ্ঠান করতেই হলে সীমিত পরিসরে অল্পসংখ্যক মানুষ নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে করুন।

শিশুদের নিয়ে অকারণে বাইরে যাবেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ। সেটা শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেই করা। তাই বলে তাদের নিয়ে সমুদ্রসৈকতে, রিসোর্টে বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ঘুরে বেড়ানো যাবে না। শিশুরা নীরব বাহক হিসেবে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

পরিবারে যিনি বয়স্ক, অন্তঃসত্ত্বা, ডায়াবেটিসের রোগী, হৃদ্‌রোগ, কিডনি রোগে বা ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছেন, তাঁকে আলাদা রাখুন। তিনি বাইরে তো যাবেনই না, যাঁরা বাইরে থেকে আসেন, তাঁরাও তাঁর কাছে যাবেন না। দরকার হলে শীতের আগে ফ্লু বা নিউমোনিয়ার টিকা ঝুঁকিপূর্ণদের দিয়ে নিতে পারেন। এতে করোনার ঝুঁকি না কমুক, অন্য রোগে হাসপাতালে ভর্তির হার কমবে।

জাগোভাটি /আআ/২২-১০-২০/