ফেঁসে যাচ্ছেন আকবরের সহযোগিতাকীরারও !

প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০২০, ১১:১৬ পূর্বাহ্ণ

জাগোভাটি ডেস্ক :: দিনকে দিন আরো গভীরে যাচ্ছে সিলেটে রায়হান হত্যার মামলার বিষয়টি। 

দীর্ঘ এক মাস পর গ্রেপ্তার হলেন রায়হান হত্যা মামলার মূল অভিযুক্ত (বরখাস্তকৃত) এসআই বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর হোসেন ভুঁইয়া। গ্রেপ্তারের পর এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আকবরকে পালিয়ে যেতে পরামর্শদাতা ‘সিনিয়র’ অফিসার। এছাড়া তাকে ভারতে পালিয়ে যেতে সহায়তাকারীদের বিষয়টিও আসছে আলোচনায়। সেই সাথে সহায়তাকারী, পরামর্শদাতা সিনিয়র অফিসার ও আশ্রদাতাদেরকেও মামলায় অন্তর্ভুক্ত করাসহ মামলার তদন্তভার র‍্যাবের হাতে দেওয়ার দাবি তুলছে রায়হানের পরিবার ও সিলেটের সচেতনমহল।

অবশ্য তাদের এ দাবিকে যৌক্তিক এবং আইনসম্মত বলে জানালেন- সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহিন।

তিনি সিলেট ভয়েসকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী কোন অপরাধী অপরাধ করার পর কেউ যদি সে অপরাধের আলামত নষ্ট করে দেয়, সে ক্ষেত্রে সেও মামলায় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় অপরাধী হবে এবং তাকেও অভিযুক্ত করা হবে। আর কেউ যদি কোন অপরাধীকে আশ্রয় দেয় বা প্রশ্রয় দেয় তাহলে সেও দণ্ডবিধির নির্ধারিত ধারায় মামলায় অন্তর্ভুক্ত হবে। সুতরাং আমি মনে করি যারাই তাকে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছে, সহায়তা করেছে, বা আলামত নষ্ট করেছে তাদের প্রত্যেককে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ।’

কারা আকবরের সহায়তাকারী?

আকবর গ্রেপ্তারের পরপর খাসিয়াদের করা একটি ভিডিওতে আকবরকে বলতে শোনা যায় ‘সিনিয়র একজন অফিসার বলেছিলেন আপাতত সরে যেতে। বরখাস্ত করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করতে পারে। ২ মাস পর সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’ সে হিসেবে কে ওই আকবরের ‘সিনিয়র’ বলতে স্বাভাবিকভাবেই থানার ওসি (তদন্ত), ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), এসি বা উত্তর সার্কেলের কর্মকর্তাদের উপর দায় বর্তায়।

এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার নিশারুল আরিফ  বলেন, ‘আকবরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে এখন পিবিআই’র কাছে রিমান্ডে আছে। পিবিআই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আমরা অপেক্ষা করছি তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি কোন অফিসারের নাম কনফার্ম করেন তাহলে আমরা তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ নিবো। সে ক্ষেত্রে পরামর্শদাতা ওই সিনিয়র ফৌজদারি অপরাধে বিবেচ্য হলে সে অনুযায়ীও তার শাস্তি হবে। এছাড়াও আমাদের বিভাগীয় তদন্তের জন্য দুইটি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। একটি কমিটি ইতোমধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে আর একটি কমিটি এখনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি। তাছাড়া আলামত নষ্ট করার জন্য এএসআই হাসান উদ্দিনকে আমাদের হেফাজতে রাখা হয়েছে। এখন পিবিআই যদি চায় তাহলে তাকে পিবিআই’র কাছে হস্তান্তর করা হবে।’

তিনি আরও বলেন- ‘আরও যারা বহিষ্কার বা প্রত্যাহার হিসেবে আমাদের হেফাজতে আছে তাদের মধ্য থেকে পিবিআই যখন যাকে প্রয়োজন মনে করবে তাকেই গ্রেপ্তার করবে এবং আমরা তাদের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত।’

এদিকে গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী আকবর গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কাছে পালিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। আকবর জানিয়েছেন, ‘১২ অক্টোবর বিকালে বন্দর ফাঁড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে রাতে শহরেই অবস্থান করে আকবর। পরদিন বিকালে স্থানীয় সাংবাদিক নোমানের সঙ্গে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ এলাকার ভোলাগঞ্জ যায়। সেখানে এক নারী জনপ্রতিনিধির বাসায় রাত্রিযাপন করে। এবং সেই জনপ্রতিনিধির স্বামীর মাধ্যমেই পরদিন ১৪ অক্টোবর ভোরে ভারতের মাঝাই গ্রামে নরেশ সিংহ নামের এক চুনাপাথর ব্যবসায়ীর বাসায় ওঠে।’

জানা যায়, আকবরকে নিজের বাসায় আশ্রয়দাতা ও ভারতে পালিয়ে যেতে সহায়তাকারী ওই জনপ্রতিনিধির নাম তামান্না আক্তার হেনা। তিনি সিলেট জেলা পরিষদের (সংরক্ষিত) নারী সদস্য। মূলত সাংবাদিক নোমানের মাধ্যমেই ওই জনপ্রতিনিধির বাসায় যান আকবর।

সূত্র জানায়, পালিয়ে যাওয়ার পর প্রথমদিন সিলেট শহরে অবস্থান করলেও পরদিন ১৩ অক্টোবর বিকালে নোমানের সাথে কোম্পানীগঞ্জ যান আকবর। সেখানে প্রথমে টুকেরবাজার এলাকার নোমানের বাসাতে কিছুসময় অবস্থান করেন। পরে সন্ধ্যার পর অন্ধকারেই মোটরসাইকেলে রওয়ানা হন নারী জনপ্রতিনিধি তামান্না আক্তার হেনার বাড়ির উদ্দেশ্যে। একদম সীমান্তবর্তী উৎমাছড়া এলাকার মাজেরগাঁও এলাকায় তামান্না আক্তার হেনার বাড়ি। সেখানে রাত্রে অবস্থান করেন আকবর। এবং পরদিন সেই জনপ্রতিনিধির স্বামী নাজমুল হক হেলাল ও সীমান্তবর্তী মাদক ব্যবসায়ী হেলালের এ দুই হেলালের মাধ্যমেই সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন আকবর। মূলত তামান্না আক্তার হেনার সাথে নোমানের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। নোমান এবং ওই নারী জনপ্রতিনিধি মিলেই উৎমাছড়ার পাথর কোয়ারি দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন। হেনার স্বামী হেলালের দুই ভাগনা শাহিন ও লাহিনকে দিয়ে উৎমাছড়া এলাকা থেকে পুলিশের নামে চাঁদা আদায় করাতেন নোমান। সে হিসেবে হেনার সাথে নোমানের সম্পর্ক বাণিজ্যিক। সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট ভয়েসে কোম্পানীগঞ্জের পাথর কোয়ারি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সে সময় নোমানের সাথে কথোপকথনের ৩৪ মিনিটের একটি রেকর্ড সংরক্ষিত আছে সিলেট ভয়েসে। ওই রেকর্ডের একটি অংশে নোমান বলেছিলেন তামান্না আক্তার হেনার সাথে তার সখ্যতার কথা। এমনকি কিভাবে কোয়ারি চালু হলে হেনার স্বামীর ভাগনা শাহিনকে দিয়ে টাকা আদায় করানো হয়।’

ইতোমধ্যে তামান্না আক্তার হেনা, তার স্বামী হেলাল ও স্বামীর ভাগনা শাহিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। আর মাদক ব্যবসায়ী হেলালকে একটি মামলায় গ্রেপ্তারও দেখানো হয়েছে। অপরদিকে নোমানকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত আছে। কেবল তাই না, নোমানের বাবা-মা, স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আর স্বজনদেরকেও নজরদারীতে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে আকবরের পালানোর এ প্রক্রিয়া গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর তাদেরকে পালাতে সহায়তাকারী ওই জনপ্রতিনিধি, সিসিটিভির ফুটেজ গায়েব করার মূল হোতা নোমানসহ আকবরকে পালাতে সহায়তাকারী সকলকে খোঁজে বের করে গ্রেপ্তার করাসহ তাকে পালানোর পরামর্শদাতা সিনিয়র অফিসারকেও শাস্তির আওতায় আনার জোর দাবি জানিয়েছেন রায়হানের পরিবার ও সচেতনমহল।

রায়হানের মা সালমা বেগম সিলেট ভয়েসকে বলেন, আমি পত্রিকায় দেখলাম আকবর ভোলাগঞ্জ হয়ে পালিয়ে ভারতে গিয়েছিলো। তাদেরকে যারা সহায়তা করেছে তাদের প্রত্যেককে যেন গ্রেপ্তার করা হয়। একই সাথে মামলাটি আমি র‍্যাবের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানাই।

এদিকে অপরাধ কমিয়ে আনতে অপরাধীর সহায়তাকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানালেন সম্প্রতি সময়ে গড়ে উঠা নাগরিক সংগঠন ‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’ এর সংগঠক আব্দুল করিম কিম। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখলাম আকবর বলেছে তাকে পালিয়ে যেতে সিনিয়র অফিসার পরামর্শ দিয়েছেন। তাছাড়া নোমান নামের একজন সাংবাদিক সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করল, জনপ্রতিনিধি তাকে ভারতে পালিয়ে যেতে সহায়তা করলেন। সব মিলে আমার মনে হচ্ছে এসব যেন অপরাধকে সমর্থন করা এবং উস্কে দেওয়ার মতো। তাই তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। একই সাথে এ মামলাটি র‍্যাবের কাছে হস্তান্তর করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

একই মন্তব্য করলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘পুলিশের উচিৎ নিজেদের স্বচ্ছতার জন্য আকবরের পরামর্শদাতাদের বের করা। এমনকি তাদেরকে যারাই সহায়তা করেছেন তাদের প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করা। কিন্তু তারা তা করবেন বলে আমার মনে হয় না। কারণ পিবিআই আলাদা ইউনিট হলেও তারাও পুলিশ। তাই মামলাটির তদন্তভার র‍্যাবের কাছে হস্তান্তর করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।’ একই সাথে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান তিনি।

এদিকে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তার করণীয় সম্পর্কে অভিহিত করে বলেন, ‘নিয়ম হল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে কেউ তাকে কোন পরামর্শ দিয়ে থাকলে বা পালিয়ে যেতে সাহায্য করলে তাকেও মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা। কারণ, সে সময় যেসব আলামত নষ্ট হয়েছে সেখানে রায়হানের ডিএনও থাকতে পারত। কিন্তু এসব নষ্ট করা হয়ে গেছে।’

তবে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদুজ্জামান  জানান, আমরা মূলত পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ও একটি হত্যা মামলার তদন্ত করছি। আমাদের মূল টার্গেট ছিলো আকবর। তাকে আমরা পেয়েছি। এখন সে আমাদের কাছে। ৭ দিনের রিমান্ড চলছে আকবরের। তার কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্যের আলোকেই যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং মামলার পরবর্তী ধাপ এগুবে। সময়মত আনুষাঙ্গিক সকল কিছু মামলায় আসবে। কে কিভাবে সহযোগিতা করেছে সকল কিছু মাথায় রেখেই মামলার তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

 

জাগোভাটি /আআ/১৩-১১-২০/