দেশের ১১ কোটি নেট ব্যবহারকারীর ডিজিটাল প্রহরী কে

প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ৭:২৩ অপরাহ্ণ

জাগোভাটি ডেস্ক ::দেশের ১১ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কোনো না কোনো ভাবে ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত। ব্যক্তিগত কাজ, আর্থিক লেনদেন, দাপ্তরিক ও অফিসের কাজসহ বেশিরভাগ কর্মসম্পাদন হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে।

ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপেও প্রতিনিয়ত কোটি কোটি তথ্যের আদান-প্রদান হচ্ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডিজিটাল অপরাধ। সরকারের অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান যার যার মতো করে কাজ করলেও কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজিটাল অপরাধ ও সমস্যা সমাধানে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামগ্রিক অর্থে ডিজিটাল নিরাপত্তা, সুরক্ষা, অপরাধ ও সমাধানের বিষয়গুলো দেখতে হবে। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধোঁয়াশা আছে। তারা জানেন না সমস্যা হলে কোথায় যাবেন, কি করবেন।

কোথায় গেলে মিলবে দ্রুত সমাধান। প্রশ্ন উঠেছে, ১১ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ডিজিটাল প্রহরী আসলে কে? ডিজিটাল সুরক্ষা ও সমস্যার সমাধানের দায়িত্বটা আসলে কার।

কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (বিজিডি ই-গভ সার্ট) সাইবার নিরাপত্তা, দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি কাজ করছে। অন্যদিকে বিটিআরসি, টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর, র‌্যাব, সিআইডি, ডিবি সাইবার ক্রাইম বিষয়ক মনিটরিং ও কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অপরাধ ও তার সমাধানে একই ছাতার তলে থাকা কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. বিএম মইনুল হোসেন বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করবে, ডিজিটাল অপরাধ নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সাইবার ক্রাইম টিম, সাইট-অ্যাপ ব্লক করার বিষয়ে বিটিআরসি রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়গুলোতো একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত।

হোক সেটা আন্তর্জাতিক, রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যায় পড়লে জানেন না কোথায় গেলে সমাধান মিলবে। বিক্ষিপ্তভাবে অনেক তথ্য দেয়া আছে। ৩৩৩-এর কথা বলা আছে।

কিন্তু সেখানে রেসপন্সই করে না। এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। তিনি বলেন, ইন্টারনেট দিয়েছেন কিন্তু সমস্যা হলে আস্থার কোনো জায়গা দিতে পারছেন না, এটা মেনে নেয়া যায় না।

একটা কেন্দ্রীয় সংস্থা প্রয়োজন যেখানে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর রাষ্ট্রীয় সমন্বয় করা হবে। দেশের মানুষ যেমন জানে ঢাকা মেডিকেলে গেলে কেউ বলে না আমাদের শিশু বিশেষজ্ঞ নেই, গাইনোকলোজিস্ট নেই। অর্থাৎ চিকিৎসা সেখানে পাবে। তেমনি ডিজিটাল নিরাপত্তা, অপরাধ ও তার সমাধানেও একটা আস্থার জায়গা লাগবে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের নিয়ন্ত্রণেও কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। যার সঙ্গে সমন্বয় করে সবাই কাজ করবে।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন-আমেরিকা, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের নানা দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতে কেন্দ্রীয়ভাবে অনেক কাজ হয়। আমাদের দেশেও হচ্ছে, তবে বিক্ষিপ্তভাবে। সমন্বয় দরকার। শক্তিশালী কৌশলগত কমিটি দরকার যারা পরিকল্পনাগুলো করবে। সেখানে সাইবার হুমকিগুলো চিহ্নিত করা হবে। তারপর বিভিন্ন খাত বিবেচনায় এ বিষয়ে আলাদা কৌশল নেয়া হবে। কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকবে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে নানা শাখা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তার সঙ্গে যুক্ত হবে। তাদের তথ্য-উপাত্ত দেবে শাখাগুলো। তারা সে অনুযায়ী অ্যাকশন নেবে। আর সার্টের কাজ হবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করা। টপ টু বটম একটা স্টাব্লিশমেন্ট এবং তার ভেতরে কো-অর্ডিনেশন দরকার।

তিনি বলেন, আমাদের এখানে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে বিনিয়োগ কিন্তু কম হয়নি। তবে বেশিরভাগই মনিটরিং নির্ভর। কে কি করল সেটা দেখার বিষয়ে আমরা অনেক বেশি উদগ্রীব। কিন্তু কোটি কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা ততটাই উদাসীন। মনিটরিংয়ের দরকার আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ১১ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে ১০ হাজার মানুষ খারাপ হতে পারে। বাকিদের জন্য আমরা কি করেছি। শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ডিজিটাল জ্ঞান, নিরপত্তার বিষয়গুলো সংযুক্ত করতে হবে।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, ওয়েবসাইট বিষয়ক কোনো হ্যাকিং হলে সেখানে পুলিশের সঙ্গে কাজ করছে ন্যাশনাল সার্ট বা বিডি সার্ট। আবার ফেসবুক বিষয়ক কোনো সমস্যা থাকলেও বিডি সার্ট দেখার কথা। বিডি সার্ট এ সংক্রান্ত ৩৩৩ বিষয়ক হেল্পলাইন খুলেছে। তারা অভিযোগ নিয়ে রাখে। বাস্তবতা হচ্ছে, অভিযোগ নেয়ার পর বাস্তবে তারা কোনো খবর রাখে না।

যে কোনো ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুতে স্টেকহোল্ডার হচ্ছে আইসিটি ডিভিশন, ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি, সার্ট, পুলিশ, সিআইডি, ডিবি। এ প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে একটা সমন্বয় প্রয়োজন যেটা বাস্তবিক অর্থে আমাদের দেশে নেই। দেশের ভেতরে সাইবার ক্রাইমের ক্ষেত্রে আইসিটি মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় এবং বিদেশে অপরাধ সংঘটিত হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতাও প্রয়োজন।

কেন্দ্রীয়ভাবে একটি জায়গা থেকে সবার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সার্ট ও ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি অচিরেই এক জায়গায় না এলে ডিজিটাল বাংলাদেশের নিরাপত্তা আমরা দিতে পারব না। কেন্দ্রীয় ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের পাশাপাশি ৬৪ জেলাতেই এই ল্যাব লাগবে।

বিজিডি ই-গভ সার্টের পরিচালক তারেক এম বরকতুল্লাহ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি বিষয়গুলো দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমরা সম্প্রতি পুলিশ থেকে প্রত্যেক মাসে নিরাপত্তা আইনে কত মামলা হয়েছে, কটা নিষ্পত্তি হয়েছে সেটার একটা রিপোর্ট সংগ্রহ করে রাখছি। আর কল সেন্টার ৩৩৩ কার্যক্রমের উন্নতি সাধন চলছে। এ মাসের মধ্যেই ফলাফল পাওয়া যাবে আশা করছি।

সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অনুমোদন দেওয়া হয়। সেখানে বলা আছে, এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, একজন মহাপরিচালক ও দুজন পরিচালকের সমন্বয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি নামের একটি এজেন্সি গঠন করিবে। তবে করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির কাজ সেভাবে এগোতে পারেনি।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ২০১৮ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সংসদে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা এটার রুলস, ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি করেছি। এখন আমাদের লোকবল, জনবল অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। আমরা চেষ্টা করছি ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি পূর্ণাঙ্গ অথরিটি, এজেন্সি হিসাবে তৈরি করতে। অর্থ, জনবল, বাজেট পেলে কালিয়াকৈরে সিকিউরিটি অপারেশনস কমান্ড সেন্টার (ন্যাশনাল সক) স্থাপন করব।

তিনি বলেন, গত এক যুগে ডিজিটাল কর্মকাণ্ড যেভাবে বেড়েছে তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ভাইয়ের ভিশন রূপকল্পকে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি বলে হয়েছে।

বর্তমানে আর্থিক লেনদেন থেকে শুরু করে, সরকারি সেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, বিচারিক ব্যবস্থা সবই চলছে অনলাইনে। এটাকে ডিজিটাল নিরাপত্তাও দিতে হবে। ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি এবং কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (সার্ট) কাজ করে যাচ্ছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, অপরাধীরা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে।

ডিজিটাল পদ্ধতির ফাঁকফোকর দিয়েও অপরাধ হবে। সোশ্যাল মিডিয়া একদিক থেকে মানুষের কাজে লাগে, অন্যদিক থেকে অপরাধের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করতে পেরেছি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে ডিজিটাল দুনিয়া প্রতিনিয়ত বদলায়। আইনেরও ফাঁকফোকর দাঁড়িয়ে যায়। আইনের সংশোধনী বা নতুন আইন প্রণয়নও করতে হতে পারে। এখানে আসলে পুরো দুনিয়া মনিটর করার দরকার আছে। রাতারাতি সবকিছু করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট যত সংস্থা আছে তারা সবাই চেষ্টা করছে।

বিটিআরসি থেকে তাদের নিজস্ব সাইবার সিকিউরিটি সেল গঠনের কথা বলা হয়। এ বিষয়ে মোস্তাফা জব্বার বলেন, বিটিআরসি ডিজিটাল দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। মোবাইল ফোন, আইএসপি থেকে আরম্ভ করে ডিজিটাল কানেক্টিভিটি সব তারা করে। বিটিআরসি এ দুনিয়ায় অনুপস্থিত থাকতে পারে না। ডিজিটাল দুনিয়ার নিয়ন্ত্রক হব, আর ডিজিটাল দুনিয়ার খবর পাব না-এটা হতে পারে না। তাদেরকে ডিজিটাল সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রযুক্তি সংগ্রহের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। তাদের নেগোসিয়েশন করার দক্ষতা তৈরি করতে হবে।

বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, এই সিকিউরিটি সেল সিকিউরিটি পয়েন্ট অব ভিউ থেকে কাজ করবে সব স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে। এর মধ্যে আইন, বিধি, জনস্বার্থ সব বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কাজ করবে। এখানে বিভিন্ন টেলিকম সেক্টরের প্রতিনিধিরা থাকবে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধিরাও থাকবেন।