রাজনীতিকে রঞ্জিত করেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত

প্রকাশিত: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৮:২৪ অপরাহ্ণ

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বাংলাদেশের রাজনীতির এক অসাধারণ নাম। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে জন্ম নেওয়া এই রাজনীতিবিদের জীবন ছিল নানাবৈচিত্রতায় ভরপুর। তার জীবনকে এক কথায় বর্ণাঢ্য বলে শেষ করে দেয়া যাবে না। প্রায় পাঁচ দশকের রাজনীতির জীবন ছিল প্রখ্যাত এই রাজনীতিবিদের। গত শতকের মাঝামাঝি সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বৃটিশবিরোধী আন্দোলন তখন শেষ। বৃটিশরা ভারত ছাড়ার তোড়জোড় করছে। সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগ চূড়ান্তপ্রায়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জন্মগ্রহণ করলেন অবিভক্ত ভারত বর্ষে ১৯৪৬ সালের ৫ মে। এক বছরের একটু পরেই দেশ ভাগ হলো, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্মভূমি সিলেটের সুনামগঞ্জ পড়লো পাকিস্তান রাষ্ট্রে। স্বাধীন রাষ্ট্র কিন্তু সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত ছিল না ওই রাষ্ট্রে। যেহেতু মুসলিম রাষ্ট্র, সেহেতু স্বভাবতই অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল পাকিস্তানে কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।

কেবল ধর্মের কারণে বৈষম্য ছিল তা নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেক রাষ্ট্রটি বাঙালিরও স্বার্থবিরোধী। পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির মুখ থেকে তার মায়ের ভাষাও কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছিল। ফলে নবীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু হয়েছিল ৪৮ সাল থেকেই। তাই এটা বলা যায় যে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বেড়ে উঠছিলেন এক বৈরি ও প্রতিবাদী পরিবেশে। পরিবেশ-পরিস্থিতি মানুষের মানস গঠনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তেরও করেছিল বলেই তিনি রাজনীতির দুর্গম পথে হেঁটেছেন সারাটা জীবন। রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা ও সম্মান পেয়েছেন। তবে শীর্ষে আরোহণের জন্য তাকে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।

ছাত্রজীবনেই রাজনীতিরও পাঠ গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। থাকতেন জগন্নাথ হলে। তখনই জড়িয়ে পড়েন বাম ধারার ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। একবার জগন্নাথ হল ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সহ-সভাপতি পদে মনোনয়নও পেয়েছিলেন। ছাত্রাবস্থায় অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল। তবে শেষপর্যন্ত অভিনয় আর টানেনি। অভিনেতা থেকে নেতা হয়ে গেলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ষাটের দশকে ছাত্রজীবন থেকেই জড়িত ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির সাথে। সে সময় থেকে দীর্ঘদিন একসাথে রাজনীতি করেছেন বামপন্থী নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য। তিনি বলছিলেন, সে সময় নাট্য-অভিনেতা হিসেবেও খ্যাতি ছিল মি. সেনগুপ্তের।

“হলগুলোর নাটকের প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ নাটকে সুরঞ্জিত অভিনয় করেছিল একাধিকবার। আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, অভিনেতা থেকে নেতা হয়ে গেছো তুমি”।অভিনয়ের চেয়ে রাজনীতির প্রতি টানটা বেশি ছিল বলেই রাজনীতিটাই অগ্রাধিকার পেয়েছিল।

প্রথমে ছিলেন বাম রাজনীতিতে। সমাজতন্ত্র তথা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন) প্রার্থী হিসেবে ১৯৭০ সালের পাকিস্তানভিত্তিক নির্বাচনে সুনামগঞ্জের একটি প্রাদেশিক পরিষদ আসনে জয়ী হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের ওই জোয়ারের মুখেও তিনি নির্বাচিত হয়ে একদিকে যেমন নিজের জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিয়েছিলেন, অন্যদিকে রাজনীতির আকাশে নতুন তারার উদয়বার্তারও ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই যে উত্থানপর্বের সূচনা, সেটাকে কেবল সামনেই এগিয়ে নিয়েছেন। পথটা মসৃন ছিল না। ফুল বিছানো তো নয়ই। কিন্তু বাধা অতিক্রমের দুর্দান্ত শক্তি বা ক্ষমতা তার ছিল।

প্রথমে ছিলেন ছোট দলের বড় নেতা । ন্যাপের ঘর তার রাজনৈতিক আকাঙক্ষা পূরণের উপযুক্ত ছিল না। তিনি ন্যাপ ছেড়ে বামপন্থি অন্য দল গড়ার চেষ্টা করেছেন। একতা পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি ইত্যাদি। কিন্তু তার জন্য এই দলগুলো ছিল ছিল খুবই ছোট। তাই এক সময় তিনি এ দেশের ঐতিহ্যবাহী এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ছোট দল থেকে বড় দলে গিয়েও তিনি ছোট নেতা ছিলেন না। বড় দলেরও বড় নেতাই হয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এক–এগারোর সময় দলে সংস্কার প্রস্তাব করে তিনি অন্য তিন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছিলেন। তারপরও ধাক্কা সামাল দিয়ে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হয়েছিলেন। মন্ত্রীর মর্যাদায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। রেল মন্ত্রী হয়ে অবশ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তাকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছিল। এটা ছিল তার অতি উজ্জ্বল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সবচেয়ে ম্লান অধ্যায়।

বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম চিরদিন উজ্জ্বল হরফেই লেখা থাকবে। তিনি সাত বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তার ঈর্ষণীয় খ্যাতি ছিল। সংসদে তিনি অসাধারণ সব বক্তব্য দিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তিনি যে যুক্তিশেল নিক্ষেপ করতেন তা ছিল অব্যর্থ। কি সরকারি দলে, কি বিরোধী দলে – সংসদে তিনি ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তাকে যারা অপছন্দ করতেন, তারাও তাকে উপেক্ষা করতে পারতেন না। তিনি নবীন সংসদ সদস্যদের কাছে তিনি ছিলেন শিক্ষকতুল্য।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মানুষ। সদা হাসিখুশি প্রাণবান এবং সবার সঙ্গে প্রীতি ও সৌহার্দময় সম্পর্ক তার মতো আর খুব বেশি জনের আছে বলে মনে হয় না। অত্যন্ত সুরসিক অথচ রাজনীতিজ্ঞ এই মানুষটি মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পার্লামেন্টে তিনি একাই ছিলেন একশ। তার শানিত বক্তব্য সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতো।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাকে স্নেহ করতেন, পছন্দ করতেন। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে তিনি কিছু বিষয়ে আপত্তি থাকায় স্বাক্ষর করেননি।

ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতি থেকে উঠে আসা এই নেতা ২০১৭ সালের আজকের দিনে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গত শতকের ষাটের দশকে শুরু, শেষ হলো ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। সময়টা নেহায়েত ছোট নয়!

 

লেখক:আশরাফ আহমেদ

সাধারণ সম্পাদক এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি