‘আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও’

প্রকাশিত: ৯ এপ্রিল ২০২২, ৬:৫৯ অপরাহ্ণ

বাবা কোথায়? বাবাকে ফিরিয়ে দাও। আমরা কষ্ট পাচ্ছি। আমরা ছোট বাচ্চা। আমাদের কষ্ট দিও না। চার বছর বয়সী জালসান বিনতে হাসান। বাবাকে দীর্ঘ পাঁচ মাস না দেখার যন্ত্রণায় কাতর। এরই বহিঃপ্রকাশ তার এ আকুতি। তার ছোট ভাই আফরাহিম আল মেহেদী।

অনেক কিছুই বুঝতে পারে না এখনো। মুখ ভার করে থাকে প্রায়ই।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের লাল মাহমুদের বড় সন্তান ইমাম মাহাদী ডলার। গত ৬ই নভেম্বর ফুলবাড়িয়ার ছনকান্দা বটতলা এলাকায় নিজের ফিশারি প্রজেক্ট থেকে ফেরার পথে নিখোঁজ হন। পরিবারের দাবি, সাদা পোশাকে ৪-৫ জন লোক একটি মাইক্রোবাসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে আরও ২টি মোটরসাইকেলে কয়েকজন ছিল।

নিখোঁজ ডলারের মেয়ে জালসান বিনতে হাসান বলেছে, আমার বাবা হারিয়ে গেছে। আল্লাহ আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও। আমারা দুই ভাইবোন ছোট। আম্মুও কষ্ট পাচ্ছে। আমাদেরকে আর কষ্ট দিও না। আমরা সবসময় বাবার অপেক্ষায় থাকি। আম্মুকে সবসময় বলি আম্মু আমার বাবা কোথায়? আমি ঘুমিয়েও বলি আমার বাবা কোথায়? বাবাকে না দেখলে বুকের মধ্যে অনেক কষ্ট হয়। সবাই আমার বাবাকে খুঁজে দেন।

ডলারের স্ত্রী মোনতাহেনা পিংকি  বলেন, আমার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর দুইদিন তাকে অনলাইনে দেখেছি। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ সবকিছুতে সে অ্যাকটিভ ছিল। তারপর আমি মেসেজ দেই কিন্তু সিন হলেও কোনো রিপ্লাই নেই। তখন আমি আমার দেবরকে তার নম্বর ট্রাক করার জন্য বলি। সেখানে লোকেশন দেখা যায় উত্তরায়। এর আগে আমার স্বামীকে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে একবার রাত দুইটায় র‌্যাবের ইউনিফর্ম পরিহিত কয়েকজন ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাদের কাছে কারণ জানতে চাওয়ায় তারা বলেন, আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করে আবার দিয়ে যাবো। কিন্তু র‌্যাব-১৪ বাদী হয়ে ডলারের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। মামলার কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, তার কাছে লিফলেট, ইসলামি বই পেয়েছে। কিন্তু এসব অভিযোগ সত্য নয়। দুই মাস পর হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন পান। তারপর থেকে তার ব্যবসা ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে আবার আমার স্বামী নিখোঁজ হয়ে গেলেন।

আশপাশে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, ৬ই নভেম্বর ফিশারি প্রজেক্ট থেকে ফেরার পথে সাদা পোশাকে ৪-৫ জন আমার স্বামীকে ধরে একটি মাইক্রোবাসে উঠায় এবং সেখান থেকে চলে যায়। তাদের সঙ্গে আরও ২টি মোটরসাইকেলে কয়েকজন ছিল। ঘটনাটি ঘটে বিকাল ৫টা ১০ মিনিটের দিকে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী আমাদের পরিবারকে চিনতেন। তিনি আমার শ্বশুর লাল মাহমুদকে ঘটনাটি জানান। তারা বলেন, ঘটনার দিন সেখানে মাইক্রোবাসটি সারাদিন ধরে রাখা ছিল। ঘটনার ২ দিন পর আমরা এ বিষয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করি। সকাল থেকেই তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছিল মনে হচ্ছে। তার এখনো কোনো সন্ধান পাচ্ছি না। এই পর্যন্ত ঢাকা ও ময়মনসিংহ তিনটা সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছে।  এখন পর্যন্ত কোথাও থেকে কোনো সন্ধান পাচ্ছি না। আমার ছোট বাচ্চাগুলো নিয়ে হতাশ। কোথায় যাবো এদের নিয়ে। কোথায় খুঁজে পাবো আমার স্বামীকে। মেয়েটা সবসময় বাবা বাবা করে কাঁদে। ছেলেটা তো অবুঝ। তবুও মন খারাপ হয় বাবার জন্য।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোনতাহেনা পিংকি বলেন, আমার স্বামী যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তাহলে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসুক। তাকে শাস্তি দিক। এভাবে গুম করে রাখা হয়েছে কেন? আমার বাচ্চাগুলোকে কারা এমন কষ্ট দিচ্ছে। সরকারের কাছে আমার দাবি, আমার স্বামীকে যেন সুস্থ শরীরে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন। আমার বাচ্চারা যেন বাবা হারা না হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আমার আবেদন আমার স্বামীকে খুঁজে দেন। তাকে ছাড়া আমার এবং বাচ্চাদের জীবন অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জানি না এর শেষ কোথায়।

২০১৫ সালে ডলারের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আমার স্বামী পরিবারের বড় সন্তান। মেয়েটা সবসময় ওর বাবার কথা বলতে থাকে। খেতে গেলে, ঘুমাতে গেলে বাবার কথা বলবেই। সন্তানরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে বাবার শোকে। বলে, আমিতো আমার বাবাকে অনেক মিস করছি। বাবা কী আর কোনোদিন আসবে না। কে বা কারা নিয়েছে এখন সেটা কিছুই জানি না। একটা মানুষ মারা গেলে তবুও সান্ত্বনা পাওয়া যায় কিন্তু এখন তো শুধু আমরা অপেক্ষা করেই যাচ্ছি। কোথাও পাবো? কখন আসবে ফিরে? মুহূর্তগুলো অনেক কঠিন। আমার স্বামী ফিরে না আসলে আমরা অনেক বিপদগ্রস্ত হয়ে যাবো। কি করবো, কোথায় যাবো, কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবো? সে ফিরে না আসলে কোনো কুল থাকবে না আমার সন্তানদের। বাবা ছাড়া দুই সন্তানের জীবন অনিশ্চিত। সে তার সংসার এবং ব্যবসায়িক জীবনের প্রথম ধাপে ছিল। তাকে যদি এই মুহূর্তে হারিয়ে ফেলি জানি না জীবনে কী অপেক্ষা করছে। এই ঘটনা নিয়ে একটা জিডিও করা হয়েছে কিন্তু তার এখনো কোনো অগ্রগতি দেখি না। পরিবারের পক্ষ থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে ডলারের নিখোঁজের বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। কিন্তু এখনো কোনো উত্তর আসেনি। আমরা ময়মনসিংহ সদরে র?্যাব, ডিবি, পুলিশ অফিসে গিয়ে জানতে চেয়েছি উনারা কেউই কিছু জানেন না এই বিষয়ে। দেখতে দেখতে পাঁচ মাস হয়ে গেছে এখনো কোনো খোঁজ নেই। আমার অবুঝ সন্তানেরা যখন তার বাবাকে খোঁজে তখন আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। ডলারের বাবা-মাও তাদের সন্তানদের ফেরত পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।