প্রতিবারই কেন ভাঙে বাঁধ : নেপথ্যে কাদের হাত?

প্রকাশিত: ৯ এপ্রিল ২০২২, ৭:৪৬ অপরাহ্ণ
আশরাফ আহমেদ ::‘ইবার কিতা খাইয়া বাঁচমু? পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ক্ষোভ প্রকাশ  করে কিতেশ আরও  বলেন, ‘চোর ওখল বানটা না বাইন্দা টাকা মাইরা খাওয়ায় আমরার রিজিক নষ্ট হইছে। এই চোরেরার কিচ্ছু (কিছু) অয়ও না। বিচার কার কাছে দিতাম ?, এই দেশে কোন চুরের ওই বিচার ওয়না।  যে-সখল চোরেরার লাগি আমরা অসহায় মানুষের সবকিছু পানিতে ভাইস্যা গেল, ওইসব চোরের বিচার সৃষ্টিকর্তার কাছে চাই ’ ভেঙে যাওয়া বাধেঁর পাশে বসে এভাবেই আহাজারী করছিলেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ঘুঙ্গিয়ারগাঁও গ্রামের কৃষক কিতেশ বাবু ।
 ভাটির দেশ সুনামগঞ্জে বাঁধ ভেঙে হাওরের ধান তলিয়ে যাওয়ার চিত্র নতুন নয়। গেল পাঁচদিনে সুনামগঞ্জের কয়েকটি উপজেলার ৯ টি হাওর তলিয়ে গেছে। বাকিগুলো ও আছে মারাত্মক ঝুঁকিতে।
সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত কম হলেও সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওর এলাকায় পানি বেড়েই চলেছে। জেলার যাদুকাটা, সুরমা, বৌলাই, কুশিয়ারা, রক্তি, মনাই, সুমেশ্বরী, কালনী নদীর পানি বাড়ছে দ্রুত বেগে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধে দেওয়া হচ্ছে মাটিভর্তি বস্তা ও বাঁশ। প্রায় প্রতিটি হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ অংশে স্থানীয় কৃষকরা স্বেচ্ছায় এভাবে বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন। রোজার মধ্যেও রাতদিন পড়ে আছেন বাঁধের গোড়ায়। তাতেও কাজ হচ্ছে না।  প্রবল পানির চাপে নড়বড়ে বাঁধগুলো নিমিষেই ভেঙে যাচ্ছে।
সরকারি তথ্যমতে এবছর সুনামগঞ্জের ১২ টি উপজেলার ৫২ টি হাওরে  প্রায় ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। যার উৎপাদন লক্ষমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ১৩ লক্ষ মেট্রিকটন। জেলার ২৫ লাখ মানুষের অধিকাংশ নির্ভরশীল এই হাওরের ওপর।  ফসলের যাতে কোন রকমের ক্ষতি না হয়, এজন্য বাধঁ সুরক্ষাসহ ফসল রক্ষার যাবতীয় কাজের জন্য সরকার থেকে র্পযাপ্ত বরাদ্ধ দেওয়া হয়। এবছর জেলায় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ আসে। কিন্তু এতো বিশাল বাজেট আসলেও কাজের কাজ  কিছুই হয় না। বরাদ্ধ আসলে টাকা নিয়ে চলে হরিলুট কান্ড। সুবিধাভুগিদের পকেট ভারি হয়।  তাসের নোটের মতো ভাগ হয় কৃষকের ফসল রক্ষা বাঁধের টাকাগুলো।
২০১৭ সালে বাধঁ ভেঙে সুনামগঞ্জের অধিকাংশ হাওর পানিতে তলিয়ে যায়। পরবর্তীতে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষিতে টিকাদার ও বাধঁ সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ৫ বছর হয়ে গেলেও  যার একটির বিচারও হয়নি। অভিযুক্তদের  অনেকেই মামলা থেকে অব্যাহৃতি পান ।
পরবর্তীতে সরাসরি ঠিকাদারের কাছে না দিয়ে বাধঁ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য তৈরি করা হয় পিআইসি সিস্টেম। পিআইসিতে যেসব নীতিমালা অনুসরণ করার কথা বলা হয়, তার কণা পরিমাণ ও বাস্তবে কার্যকর হয় না। যেকারণে কথিত এই সিস্টেমও যেন কাল হল অভাগা কৃষকদের জন্য। খোঁজ নিলে দেখা যাবে জেলার শতকরা একটা পিআইসির কাজও ঠিকমতো হয় না। যার ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের চাপে হাওরের নড়বড়ে বাধঁগুলো সহজেই ভেঙে  যাচ্ছে।
স্থানীয় বাঁধ সিন্ডিকেট,  কৃষি অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের জন্য বছরের পর বছর বাঁধ ভেঙে ফসল নষ্টের ঘটনা হলেও আদৌও তাদের কাউকেই আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না৷  সব ধরনের তথ্য প্রমান  থাকা সত্বেও চিহ্নিত এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় হাওর অঞ্চলে কৃষকের কান্না দিনদিন বেড়েই চলছে।
বছরের পর বছর বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল নষ্ট হবার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তারমধ্যে  নদী ভরাট, দখল -দুষণ অন্যতম। যেকারণে এসব সমস্যাগুলো আগে সমাধান করা উচিত। প্রভাবশালীদের কাছ থেকে নদীকে রক্ষা করতে হবে। পুরোপুরি দখল-দুষণ বন্ধ করে নদীর সীমানা নির্ধারন করে দ্রুত ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।  দেশের খাদ্য চাহিদার সিংহভাগ  পূরণ করে সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে পারলে এর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। হাওরের ফসল নষ্টের এই ভয়ংকর অভিশাপ থেকে স্থায়ী সমাধান আসবে৷ এটা সবাই বুঝেন। তারপরও কিছু মানুষের পকেট ভারি করার জন্য বছরের পর বছর ভূল সিন্ধান্ত নেওয়া হয়। যার খেসারত দেওয়া লাগে দরিদ্র   কৃষকদের।
গেল ২-৩ বছর এতোটা বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কৃষকরা সহজেই তাদের ফসল ঘরে তুলতে পেরেছেন। পিআইসির টাকায় বাধেঁর কাজ না হলেও কোন সমস্যা হয়নি। কার পকেটে কত টাকা গেল এনিয়েও কারোরই কোন মাথাব্যাথা ছিল না। কিন্তু এবার আগাম বৃষ্টির ফলে বাধঁ ভেঙে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় ফের উঠে আসছে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র।
 গুটিঁকয়েক ব্যক্তির জন্য এবারও ভয়ংকর এক সময় পার করছেন হাওর পাড়ের মানুষগুলো। এটা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাঙা বাঁধের পাশে বসে নিঃস্ব কৃষক আহাজারি করবে। কখনও বা বাঁধের টাকা মেরে খাওয়া সেইসব চোরেরাও  কৃষকের মাথায় হাত ভুলিয়ে বলবে, আরে সমস্যা নেই, এবার চলে গেছে তো কি হয়েছে?  সামনের বছর আরও ভাল কিছু পাবা। স্যাুট -কোড পড়া এইসব মুখোশধারী সাহেবদের দিকে নিঃস্ব কৃষক থাকিয়ে রবে !
ভাঙছে বাঁধ,  হাওর তলিয়ে যাচ্ছে।
সবাই খুব কথাবার্তা বলছেন, বিক্ষোভ,  মাবনবন্ধন হচ্ছে। শহর থেকে নেতা যাচ্ছেন। তাদের চামচারা রঙিন ছবি তুলে ফেসবুকে ফাটিয়ে দিচ্ছে ল। সরগরম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও। দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনার দাবীও উঠছে। এটা কয়েকদিন থাকবে। কিছু মানুষের নামে হয়তো লোকদেখানো মামলাও হবে । মানুষের আন্দোলন কিংবা কথাবার্তা একটা সময় বন্ধ হয়ে যাবে। মামলায় থাকা সেসব ব্যক্তিদেরকেও অব্যাহৃতি দেওয়া হবে । কিন্তু  সর্বস্বান্ত হওয়া এইসব কৃষকের কি হবে? ফসল হারানো কৃষকদের জন্য সরকার থেকে হয়তো কিছু বরাদ্দ আসবে। সেই বরাদ্দ নিয়েও চলবে হরিলুট খেলা। ভুক্তভোগীরা এর সামান্য চিটা ফোটা হয়তো পাবে। পরে সবাই যে যার মতো মতো ব্যস্থ হয়ে যাবে।  পরের বছর আবারও পিআইসি নামক কথিত সিস্টেমে আয়োজন করা হবে দুর্নীতির মহোৎসবের। একই নিয়মে বরাদ্দ  নিয়ে চলবে হরিলুট খেলা। ফলস্বরুপ বাধঁ ভেঙে পানিতে তলিয়ে যাবে কৃষকের স্বপ্নের ফসল।  কিতেশ বাবুরা সেই ভাঙা বাধেঁর গোড়ায় বসে আহাজারি করবে আর ‘ এই দেশে কোন চুরের ওই বিচার ওয়না ; বলে  হাত তুলবে আকাশের দিকে।
লেখক: আশরাফ আহমেদ
সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি।