নির্বাচনী যোগ বিয়োগ

প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২৩, ৮:৫৯ অপরাহ্ণ

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করছে না নির্বাচন কমিশন। শাসক দল আওয়ামী লীগের চাপাচাপিতে দেড়শ আসনে ইভিএম-এ নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েও পিছিয়ে যেতে হয়েছে কমিশনকে। এ জন্য ৮০০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েও সরকারের কাছ থেকে অর্থ না পাওয়ায় ইভিএম-এ ভোট না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কমিশন।

বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো এবং নাগরিক সমাজের অনেকে ইভিএম বিরোধিতা করছিল। কমিশন যদিও বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যন্ত্রে ভোট গ্রহণ বাতিল করেনি, তবুও বিএনপি কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু তবুও আগামী সংসদ নির্বাচন সম্পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক করা নিয়ে সংশয় কাটেনি। বিএনপির কোনো কোনো নেতা মনে করেন তাদের ভোটে আনার কৌশল হিসেবে সরকারের ইশারায় ইসি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিএনপি তার দাবিতে অনঢ় রয়েছে যে, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সে নির্বাচনে যাবেনা। এর মধ্যেই দলটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ গ্রহণ ছেড়ে দিয়েছে। তাদের প্রার্থী যারা স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছেন তাদের দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও অটল আছে যে, নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে এবং তত্ত্বাধায়কে আর ফেরা হবেনা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বোধগম্য যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বড় দুই দলের মধ্যে সমঝোতার জায়গা সৃষ্টি হয়নি।

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে আমরা যেমন চেয়ে আছি, তেমন তাকিয়ে আছে বিশ্ব সম্প্রদায়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো দেশগুলো অনেক কথা বলছে এই নির্বাচন নিয়ে। সম্প্রতি আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি জে ব্লিঙ্কেন। বৈঠকের শুরুতেই দেশের অত্যাসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য করার নিশ্চয়তা চাইলেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী। ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর যে বার্তা দিয়েছে এই বৈঠিক শেষে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করেছেন ব্লিঙ্কেন। এতদিন নিজেদের কথা বললেও, এবার যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বিশ্ব আগামী নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। এও বলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রও তাকিয়ে আছে যাতে বাংলাদেশ এই অঞ্চল ও বিশ্বের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের শক্তিশালী উদাহরণ তৈরি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বার্তাটি বেশ পরিষ্কার এবং কিছুটা কঠোরতা এর মধ্যে লক্ষণীয়। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন তাঁর সূচনা বক্তব্যে এ নিয়ে কিছু না বললেও হোটেলে ফিরে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সব দলের অংশ গ্রহণে একটি অবাধ, স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য তথা ‘মডেল’ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেয়ার কথা জানান।

২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে আসেনি, বরং প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। বিএনপির সাথে গিয়ে আরও অনেক দল সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে এক তরফা নির্বাচন হয়েছে। দেড়শরও বেশি আসনে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। বিএনপির দৃষ্টিতে সেই ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন করেও আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করে। এর মধ্যে সরকারকে জামায়াত-বিএনপির যৌথ ইতিহাসের সহিংসতম আন্দোলন মোকাবেলা করতে হয়েছে। যথা নিয়মে ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচন উপস্থিত হলে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তোলে। তবে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যায় এবং সেটা তারা করে গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে অনেক দল মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয় এবং তারা অভিযোগ করে যে, পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তায় রাতেই ভোটের বাক্স ভরে রাখা হয়েছিল। ফলে সেই নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হয়েও বিতর্কিতই থেকে গেল।

ঠিক এমন এক পরিস্থিতিতে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনায় কোন পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাচ্ছেনা। বিএনপি মহাসচিব পরিষ্কার করে বলেছেন যে, নির্দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া তারা নির্বাচন করবেন না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বিএনপির ভেতর যারা নির্বাচন করতে আগ্রহী তাদের অনেকেই সরকারি দলের সাথে যোগাযোগ রাখছে।

বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত ভোটে না যায় তাহলে দেশে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে রাজনৈতিক দলগুলো আশঙ্কা করছে। অন্যদিকে এবার পশ্চিমা দেশগুলো কূটনীতির অন্দরে ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে টানা তিনবার ভোটে প্রকাশ্যে থাকা জাতীয় পার্টি নানা হিসাব করছে। বিএনপির গতিবিধির দিকে নজরে রাখছে জামায়াতে ইসলামী ও চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনও। জাপার একটি অংশ বিএনপির সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখলেও বিএনপি যদি শেষ সময়ে এসে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন না করে তাহলে পরিস্থিতি বুঝে চতুর্থবারের মতো সরকারকে সমর্থন দিয়ে ভোটে যাবে হয়তো দলটি। এই হিসাবটা আওয়ামী লীগও করছে বলে প্রতীয়মান হয়।

সরকার পতনে এক দফার আন্দোলন করতে চায় জামায়াতে ইসলামি। সেখানে বিএনপিকে প্রকাশ্যে মাঠে চায় দলটি। বিএনপি যদি পিছু হটে তাহলে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে আবেদন করা দলটি নিবন্ধন পেলে তারা এককভাবে ভোটে যেতে তৈরি। বিএনপির ভেতরের একটি অংশ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, একটি জাতীয় সরকার চায় এবং সেই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে চায়। এমন একটি সরকার চায় চরমোনাই পীরের দলও।

আওয়ামী লীগ তার অধীনেই নির্বাচন চায়, বিজয় চায় এবং দেখাতে চায় নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছে। বিএনপি না এলেও বিএনপির হয়ে কেউ যেন নির্বাচনে আসে সেই চেষ্টাও আছে দলটির। ২০১৮ সালের মতো এক তরফাভাবে প্রায় সব আসন নিয়ে নেওয়া থেকেও বিরত থাকার পরিকল্পনা আছে দলে। রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন তখনই সম্ভব যখন রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।

 

লেখক: সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।